৬২ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গলেন লবণ চাষিরা

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাণিজ্যিক লবণ চাষে গত ৬২ বছরের ইতিহাস ভেঙে এবারই সোয়া ২১ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২২ সালে) সবচেয়ে বেশি ১৮ লাখ ১৫ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল।

গত অক্টোবর থেকে ০৬ মে পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূলের ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে ২১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। যদিও কাগজে-কলমে লবণ মৌসুম চলে ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পাঁচ মাস।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। চলতি মৌসুমে জেলা সদর, ঈদগাঁও, পেকুয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, টেকনাফ, কুতুবদিয়া ও বাঁশখালীতে ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। ০৬ মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২১ লাখ ৭৫ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে এ সময়ে উৎপাদিত হয়েছিল ১৮ লাখ ১৫ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন। এ হিসাবে চলতি মৌসুমে গত মৌসুমের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন লবণ বেশি উৎপাদন হয়েছে।

গত বছর চাষের জমি ছিল ৬৩ হাজার ২৯১ একর। গত মৌসুমের তুলনায় এ বছর লবণ চাষের জমি বৃদ্ধি পেয়েছে তিন হাজার ১৩৩ একর। চলতি লবণ মৌসুমে লবণ চাষির সংখ্যা ৩৯ হাজার ৪৬৭ জন। যা গত বছর ছিল ৩৭ হাজার ২৩১ জন। এ বছর লবণ চাষির সংখ্যা বেড়েছে দুই হাজার ২৩৬ জন।

বিসিক জানায়, লবণ আমদানি না করে দেশে লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে চলতি লবণ মৌসুমে এক মাস আগেই লবণ চাষিদের মাঠে নামানো হয়। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর লবণ উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু চলমান লবণ মৌসুমে লবণ উৎপাদন শুরু হয় ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর। লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি (এক বছর), মধ্যমেয়াদি (১-৫ বছর) এবং দীর্ঘমেয়াদি (৫ বছরের ঊর্ধ্বে) কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ২০২০ সালে যখন লবণনীতি করা হয়, তখন দেশের লোক সংখ্যা ১৮ কোটি ধরে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছিল। গণনায় এখন দেশের জনসংখ্যা পাওয়া গেছে ১৭ কোটি। এ ক্ষেত্রে ২১ লাখ মেট্রিক টন লবণ দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের বার্ষিক চাহিদা পূরণ সম্ভব। এখন দৈনিক গড়ে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে ১২ মেট্রিক টন।

সোমবার ঈদগাঁওয়ের গোমাতলী, পোকখালী, কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, টেকনাফের সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙিখালী, খারাংখালী, সিকদারপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উৎপাদিত লবণ মাঠের ওপর স্তূপ করে রাখছেন চাষিরা। আবার অনেকে সরবরাহ করছেন মিল-কারখানাতেও।

গোমাতলীর চাষি জামাল উদ্দিন ও পোকখালীর চাষি রিদুয়ানুল হক বলেন, ‘সোমবারও প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ৪৭০-৪৮০ টাকায়। সামনে আরও সপ্তাহ দেড়েক সময় বৃষ্টিহীন থাকলে আরও ভালো উৎপাদন হবে। আগামী ভরা কোটালের (প্রবল জোয়ার) সময় টানা বৃষ্টি হলেও লবণের মৌসুম শেষ হতে পারে। তখন প্রতি মণ লবণের দাম মাঠপর্যায়ে ৫০-৬০ টাকা বেড়ে যেতে পারে। প্রতি মণ লবণ ৫৫০ টাকায় বিক্রির আশায় অনেক চাষি মজুত করছেন।’

ঈদগাঁওয়ের পোকখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রফিক আহমদ বলেন, ‘টানা পক্ষকালের অধিক সময় দিনের তীব্র গরমে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছায় এবার লবণের দামও ভালোই মিলছে। গত মৌসুমে প্রতি মণ লবণ ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার ৩৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

বাংলাদেশ লবণচাষি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও মহেশখালীর লবণচাষি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, বাণিজ্যিক ভাবে লবণ উৎপাদন শুরুর ৬২ বছরে ন্যায্য দাম পাওয়ায় এবার চাষিরা উৎসাহ নিয়ে চাষ করেছেন। এতে লবণ উৎপাদনে উল্লেখ করার মতো সাফল্য এসেছে।

কক্সবাজার লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়ার মতে, মৌসুমজুড়ে দাবদাহ, কম বৃষ্টি, সাড়ে ৬৬ হাজার একর জমিতেই আধুনিক পলিথিন প্রযুক্তিতে চাষাবাদ এবং অতিরিক্ত তিন হাজার একরের বেশি জমিতে লবণ চাষের কারণে উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয়েছে। সামনে আরও যে কিছুদিন সময় পাওয়া যাবে তাতে আরও ৩০-৪০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হবে।

তিনি বলেন, লবণের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখতে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আধুনিক পদ্ধতিতে চাষিদের অগ্রিম লবণ চাষে উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ, লবণ চাষের নতুন এলাকা চিহ্নিতকরণ এবং সম্প্রসারণের উদ্যোগ চলছে। পাশাপাশি সহজ শর্তে লবণ চাষিদের ঋণ প্রদান, একরপ্রতি লবণ উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ, লবণ চাষের জমির লিজ মূল্য নির্ধারণ, লবণ চাষের জমি সংরক্ষণ, আধুনিক পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদনে প্রদর্শনী ও উৎপাদিত লবণের মান নিয়ন্ত্রণে কারিগরি সহায়তা প্রদান, জরিপ পরিচালনা, লবণ চাষ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ এবং লবণ উৎপাদন, মজুদ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ভাবে মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।